ঢাকার বাইরে যেকোনো জায়গায় আমার ঘুম আর খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালো হয়। হয়তো মন ভালো থাকে বলে এসব কিছু বেশ ভালো লাগে। সে হিসেবে গতকাল রাতে বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। যদিও একটু গরম ছিলো। কেননা বৃষ্টির কারনে ট্রলারের জানালা লাগিয়ে রাখতে হয়েছিলো। তবে মাঝরাতে বৃষ্টি কমে যাওয়াতে কেউ একজন হয়তো খুলে দিয়েছিলো। তবে আমি এর কোনো কিছুই টের পাইনি। রাতে যেমনটা বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনি ঘুম থেকে চোখ মেলে বাইরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টিই হচ্ছে। এইবারের এই অনবরত বৃষ্টি হাওড়ের ট্যুরটাকে একটা অন্যরকম অনুভূতি দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে বাকিদেরও ডেকে তুলি। কেননা গতকাল এদের কেউই ঠিকমত নীলাদ্রি দেখতে পারেনি। তাই এখন সেটা একদমই মিস করা যাবে না। তাছাড়া একটা কারনে আমাদের সকাল ১০টা নাগাদ নৌকাও ছেড়ে দিতে হবে। তাছাড়া আজ রাতে আমাদের সিলেটের খাদিমনগরের ক্যাম্পিং করার একটা প্ল্যানও আছে। তাই সবকিছু চিন্তা করে আমরাও দ্রুত ট্রলার ছেড়ে দেয়ার জন্য মনোনিবেশ করলাম।

বৃষ্টিস্নাত খুব সকালে নীলাদ্রির সবুজ সৌন্দর্য্য দেখে সবাই ট্রলারে ফিরলো। আমাদের ট্রলার রওনা হলো তাহিরপুর বাজারের উদ্দেশ্যে। গত ২২ ঘন্টার এই হাওড় স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কের একপাশ থেকে অপরপাশ নানান ধরনের অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়া, হিম শীতল বাতাস, টাঙ্গুয়ার স্বচ্ছ জলরাশি এসব উপভোগ করতে করতে সকাল ৯টা নাগাদ আমরা পৌছে যাই তাহিরপুর বাজারে। ট্রলারের সাথে করা চুক্তি মিটিয়ে সকালের পেটপুজো শেষে একটা লেগুনা ঠিক করে রওনা হই সুনামগঞ্জ সদরের উদ্দেশ্যে। দুপাশের বিশাল জলরাশি, মাঝে সবুজ পারের পাকা রাস্তায় ছুটে চলছে আমাদের লেগুনা। নানান ধরনের গল্প, আলাপচারিতায় মুখর আমরা। আর এইভাবে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌছে গেলাম সুনামগঞ্জ সদরের নতুন বাস ট্যান্ডে।
এই জায়গাটার আমিও এর আগেও একবার এসেছি। এই বছরই এসেছি। শীতের শেষে একদম বসন্তের শুরুতে। তখন সুনামগঞ্জের শিমুল বাগান লাল কমলা শিমুল ফুলে ছেয়ে ছিলো। বারিক্কা টিলা আর নীলাদ্রির ঘন ঘাসগুলো যদিও কিছুটা রুক্ষ ছিলো তবে খারাপ লাগেনি সেসময়ের প্রকৃতিকে। আসলে প্রতিটা ঋতুতেই প্রকৃতি সুন্দর। একেক রুপে সুন্দর।
সুনামগঞ্জ বাস ট্যান্ড থেকে সিলেটগামী বিরতিহীন গেইটলক বাসে চড়ে বসলাম আমরা সবাই। এবারের গন্তব্য সিলেট হয়ে খাদিমনগর রিসোর্টে চলে যাওয়া। খুব বেশীদিন হয়নি এই রিসোর্টের কাজ হয়েছে। এখন এখানে থাকার ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রি এক্টিভিটির ব্যবস্থা রয়েছে। যেটা এই রিসোর্টের অন্যতম প্রধান আকর্ষন। আর এই খাদিমনগরেই আমরা সাতটি তাবু ভাড়া নিয়েছি আজ রাতের ক্যাম্পিং-এর জন্য। সবাই বেশ এক্সাইটেড আজকের ক্যাম্পিংটা নিয়ে।

প্রায় আড়াইঘন্টা বাস ভ্রমণ শেষে আমরা পৌছে গেলাম সিলেট বাস স্ট্যান্ডে। ততক্ষনে দুপুর তিনটের কাছাকাছি। তাই দুপুরের খাবারটা খুব জরুরী হয়ে পড়েছে সবার জন্য। যেহেতু আমাদের ট্যুরগুলো খাবারের সাথে কোনো সমঝোতাটা অন্যরকম তাই সবাই মিলে চলে গেলাম সিলেটের বিখ্যাত পাঁচ ভাই রেস্ট্রুরেন্টে। সেখানে গিয়ে জমপেশ ভূড়িভোজ শেষ করে বিকেল চারটার দিকে রওনা হই খাদিমনগরের উদ্দেশ্যে। সিলেটের জিন্দাবাজার থেকে খাদিমনগর বেশ ভালোই দূরে। গুগল ম্যাপে ১৪ কিলোমিটারের মত দেখালেও চা-বাগানের কাচা আর উচুনিচু রাস্তার কারনে আমাদের পৌছাতে প্রায় এক ঘন্টার মত লেগেছিলো। আমাদের দেখে রিসোর্টে কেয়ারটেকার/ম্যানেজার (আমার ঠিক মনে নেই) কাদের ভাই-এর চিনতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। প্রায় আড়াই তিন বছর আগে একবার খাদিমনগর এসেছিলাম, তবে সেটা একটা সাইক্লিং ইভেন্ট ছিলো। সমগ্র সিলেট সাইকেল চালিয়ে ঘুরে দেখা। আমার জীবনে সেরা তিনটে ট্যুরের একটি হবে সেটি। সেই যাই হোক। কাদির ভাই বেশ আপ্যায়ন করলেন আমাদের। সময় নষ্ট না করে ব্যাগ-ট্যাগ রেখে আমরা অংশ নিলাম ট্রি এক্টিভিটিজ গুলোতে। বেশ এক্সাইটিং ছিলো এক্টিভিটিজগুলো। সন্ধ্যা নাগাদ গোসল করে সবাই মিলে বসলাম আড্ডা দিতে। আড্ডার মাঝে এককাপ চায়ের আয়োজন হয়ে গেলো। আর কয়েকজন মিলে চলে গেলো বাজারে ঘুরতে।

চুক্তি অনুযায়ী আজ রাতের ডিনারের জন্য আমাদের মেন্যু ছিলো চিকেন বারবিকিউ, ব্রেড আর সফট ড্রিংক্স। রাতভর আড্ডা আর নানান খেলার ছলে আমাদের খাবারও ওদিকে প্রস্তুত হয়ে গেলো। যে যার মত খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে গেলাম ঘুমাতে আমাদের ক্যাম্পিং এর প্রধান অংশ তাবুতে। এর আগেই এই ট্যুরের অনেক মেম্বারদের নিঝুম দ্বীপে ক্যাম্পিং-এর অভিজ্ঞতা থাকলেও সেটা সুখকর ছিলো না। তবে আজকেরটা হয়তো অতটা কষ্টদায়ক হবে না। প্রথমত, তাবুর ভেতরে আসলেই বেশ জায়গা, যেখানে অনায়াসে তিনজন ঘুমাতে পারবে সেখানে আমরা মাত্র দুজন করে ঘুমাবো। আর দ্বিতীয়ত বালিশের সুন্দর ব্যবস্থাও আছে। তাই আর কালক্ষেপন না করে সবাই শুয়ে পড়লাম যে যার মত করে। গতকাল রাতে ট্রলারে ঘুমানো আর আজ রাতে তাবুতে। কি বিচিত্র আমাদের ভালোলাগা। শহুরে ফ্যান, আরামদায়ক বিছানার আরাম ছেড়ে এই জঙ্গলে এসে রাত কাটানো!