ছাত্রজীবনের পর্ব চুকিয়ে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম তখন নিজেকে একটা লুপের মধ্যে সপে দিলাম। জীবনের ফর লুপের হাইয়েস্ট ভ্যালু পাচ সেট করে দেওয়ার কারনে রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলতে থাকে একই নিয়ম, তারপর একটা ব্রেক স্ট্যাটমেন্টের মাধ্যমে উইকেন্ডগুলো পাস কাটিয়ে আবার কন্টিনিউ স্ট্যাটমেন্টের কারনে আগের লুপে ঢুকে যায়। এ যেন না শেষ হওয়া প্রক্রিয়া। যেখানে জীবন থেকে আনন্দের রসটুকু শুষে নিয়ে, ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এক বিষন্নতার ডোজ। তাই মাঝে মাঝে বিষন্নতাকে বিদায় জানানোর জন্য মুখিয়ে থাকি টানা তিনদিনের কোনো ছুটি সামনে আসছে কি না। তাই বলা চলে, ঠিক এই কারনেই বর্তমানে ক্যালেন্ডারের সাথে আমার বেশ শখ্যতা। বেশ শখ্যতার কারনেই হয়তো মাঝে মাঝে এই ক্যালেন্ডার বন্ধু আমাকে উৎসাহিত করে একঘেয়েমি জীবনটাকে উপভোগ করতে।
তাই কিছুদিন আগেই পাওয়া টানা তিনদিনের ছুটিতে একটা ইভেন্ট প্ল্যান করে ফেললাম। প্ল্যান অনুযায়ী ঘুরে বেড়াবো আলিকদমের ঝর্না ঝিরি। থাকবো আলিকদমের সবচেয়ে সুন্দরতম রিসোর্টে। কিন্তু এই বাঙালির কারনে এখন এই লম্বা ছুটিগুলো কাজে লাগানো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। সবাই যেনো শহর ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে চায়। তাই বাস টিকিট বিড়ম্বনা একটা বিশাল প্যারা হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেও সব প্যারা নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি নাম না জানা ব্র্যান্ডের বাসের টিকিট করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এডভেঞ্চার ক্লাব (আনঅফিশিয়াল)-এর নবম ট্যুরে আমরা পাচজন ৭ই নভেম্বর, ২০১৯ইং তারিখে ঢাকা থেকে রওনা হই চকরিয়ার উদ্দেশ্যে।


পরদিন ৮ই নভেম্বর, ২০১৯ইং সকালে চকরিয়া বাজারে নেমে ব্রিটিশ আমলের জিপে করে আলিকদমের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পাহাড়ি, এলোমেলো, আকাবাকা পথ পেরিয়ে আমরা সামনে আগাচ্ছি। যতটাই সবুজ পাচ্ছি, অক্সিজেনের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্বচ্ছ বাতাসে ডুবে আছি। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন মিরিঞ্জা পাহাড়ের পথ পেলাম, তখন মনে পড়ে গেলো আমার প্রথম আলিকদম আসার স্মৃতি। যখন আলিকদম এসেছিলাম দুই চাকায় চড়ে। এই পথে কত থেমে মন ভরে পাহাড় দেখেছি তার স্মৃতি বলে কাউকে শেষ করার মত নয়। পুরোনো স্মৃতির ভীড়ে মন গুলিয়ে বেশ কিছুটা সময় পর চলে এলাম আলিকদম বাজারে। বাজারে নেমে নাস্তা করে রওনা হলাম আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা আলিকদমের অন্যতম সুন্দর রিসোর্ট শৈলকুঠীতে। আমরা কখনোও এতটা আশা করিনি এইরকম একটা জায়গায় এত সুন্দর রিসোর্ট থাকা সম্ভব।



রিসোর্টে গিয়ে কাপড় চোপড় পাল্টিয়ে বেড়িয়ে গেলাম আজকের দিনের প্ল্যান অনুযায়ী আলিসুড়ং দেখার উদ্দেশ্যে। শৈলকুঠী থেকে আলিসুড়ং খুব একটা দূরে নয়। ১৫-২০ মিনিটের মত লাগে অটোতে করে যেতে। অটো সাধারনত মাতামূহুরি নদীর এপারে নামিয়ে দিবে, তাই নদী পার হয়ে ওপর পাড়ের পাহাড়ের ঘা ঘেষে পাহাড় বেয়ে উঠে তারপর যেতে হবে আলিসুড়ং-এ।



আমাদের অটো চালক আয়াস ভাই। খুবই সহজ সরল আর সাদাসিধে মানুষ। পরিবারের অভাব অনটনের কারনে পড়াশুনা করতে পারেন নি। তাই অল্প বয়সেই জীবিকার তাগিদে জীবনকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। আমাদের শহরের মানুষের একঘেয়েমি ফর লুপের প্রভাব উনাদের উপরেও আছে। তবে তারা হয়তো নিজের এই ছোট্ট, বিলাসিতাহীন, না পাওয়া কষ্ট থেকে বেশ দূরে রাখছেন নিজেদের যা আমরা শহরের মানুষেরা পারি না।


আয়াস ভাইও আমাদের মাতামুহুরি নদীর এপারে নামিয়ে দিলেন। আমরা নেমে মাতামুহুরি নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। এখন শুকনো মৌসুম তাই নদীর পানি নেই বললেই চলে। হেটেই পার হওয়া যায় এবং আমরা তাই করলাম। নদীর পার হয়ে ওপারে পাহাড়ে ঘা ঘেষে কিছুটা পথ এগুলোই আলি সুড়ঙ্গ এর ট্রেইল শুরু হয়। যেহেতু এটা সুড়ঙ্গ এর ট্রেইল তাই স্বভাবতই বেশ সরু। উপরে ঘন ঝোপঝাড় আর গাছপালা পুরোটা পথটাকে যেনো ছায়ার মত ঘিরে রেখেছে। একটা বুনো বুনো ভাব। তবে এই পথে বেশ মানুষ ও পর্যটক আসে। তাই সামনে আগাতে কোনো প্রকার গাইডের প্রয়োজন হয় না। শুকনো মৌসুম হওয়াতে ট্রেইল ধরে সামনে আগাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তবে বর্ষা মৌসুমে এই ট্রেইলে আসতে ভালোই বেগ পেতে হবে। একে তো হচ্ছে সরু পথ, অন্যত্র পিচ্ছিল পাথর।


ট্রেইল ধরে সামনে এগুতে বেশ ভালোই লাগছিলো। ভেবেছিলাম আলি সুড়ঙ্গ এর আকর্ষন বোধহয় আরো বেশী কিছু হবে। তবে সুড়ঙ্গ খুজে পাওয়ার পর বেশ হতাশই হতে হয়েছে। অন্ধকার ছোট্ট একটা ঘরের মত। চারপাশে বেশ কিছু ছোট ছোট রাস্তা আছে তবে সেখানে মানুষ ঢুকার মত নয়। কথিত আছে, অনেক আগে আলি নামক এক ব্যক্তি এই সুড়ঙ্গ এর খোজ পান। তিনি নাকি এখানে এসে ধর্মকর্ম করতেন। এক সময় তিনি দেখা পান এক সুন্দরী পরীর। পরবর্তীতে তাদের বিয়ে হয় এখানেই। এরপর কি হয় তা কারো জানা নেই। হয়তো কারো জানার আগ্রহ নেই।

আলি সুড়ং-এ বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে মাতামুহুরি নদী পার হয়ে চলে এলাম এপাড়ে। এপাড়ে এসে টং টাইপের দোকানে দুপুরের হালকা খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে রওনা হলাম আবাসিক ঝর্না দেখার উদ্দেশ্যে। আলি সুড়ঙ্গ থেকে আবাসিক ঝর্নার ট্রেইল পর্যন্ত যেতে মিনিট ত্রিশেকের মত লাগে। আধাঘন্টার মধ্যেই পৌছে গেলাম সেখানে। অটো থেকে নেমে আরো আধঘন্টার মত হেটে পৌছে গেলাম আবাসিক ঝর্না। নাম যেমন আবাসিক, ঝর্নার দেখতেও আবাসিক। অর্থাৎ খুবই ফর্মাল টাইপের ঝর্না, যা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষনীয় টাইপ। তবে আমরা দেখে খুব হতাশ হলাম। এই রকম ঝর্না দেখার ইচ্ছে আমাদের কখনোই ছিলো না।


আবাসিক ঝর্নার উপরের দিকের ট্রেইল ধরে হেটে পাহাড়ে ঘা ঘেষে চুড়াকে বলা হয় মারায়তং চুড়া বা পাহাড়। আলিসুড়ং ঘুরে, আবাসিক ঝর্না পর্যন্ত আসতে ততক্ষনে বিকেল হয়ে গেছে। মারায়তং চুড়ায় উঠতে আরো ঘন্টা দেড়েকের পথ। ছোট দিনের কারনে চুড়ায় উঠতে উঠতে সন্ধ্যা নেমে যাবে, আর অন্ধকারে হয়ে গেলে পাহাড় থেকে নামাটাও বেশ ঝামেলার আর ভোগান্তির। সবকিছু চিন্তা করে আমরা মারায়তং উঠার সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম। তবে অন্য কোনোবার আসলে অবশ্যই এই চুড়ায় না উঠে আসবো না।

মারায়তং পাহাড় স্থানীয় পাহাড়িদের একটি পবিত্র স্থান। উপরে এক বুদ্ধ মন্দির আছে। তবে আমরা আমজনতা পর্যটক সেখানে উঠে ক্যাম্পিং করে, নোংরা করে আসে। যা স্থানীয়দের বিশ্বাসের পরিপন্থী হয়ে উঠছে। ঠিক এই কারনে বেশ কিছুদিন আগে এই চুড়ায় ক্যাম্পিং করা নিষিদ্ধ করেছেন আলিকদমের দায়িত্বে থাকা সামরিক বাহিনী।

আবাসিক ঝর্নার ওখানে বিকেলটা কাটিয়ে আমরা রওনা হই আমাদের রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে সান্ধকালীন নাস্তা সেরে নিয়ে, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা পৌছে যাই রিসোর্টে। রিসোর্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বসে যাই রাতের খাবারের জন্য। তবে রাতের খাবারের এই মূহুর্তটা সত্যিই চমকপ্রদ ছিলো। এত মজাদার বাংলা খাবার আমি ঢাকাতেও কখনো খাইনি। ভরপেট খাওয়া দাওয়া শেষে চলে রাতভর গল্প। সেই গল্প ছিলো নিজেদের, ছিলো কারো জীবনের, ছিলো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব হীন কিছু সমাপ্তির।
Pingback: আলিকদমের ঝর্ণা, ঝিরি ও সুড়ঙ্গ অভিযান – পর্ব দুই – Jubayer Alam
Pingback: NSU, Semester Break এবং Adventure Club – Jubayer Alam
viagra online store review viagra canada pfizer 100 mg viagra online